কথা সাহিত্য

 
 
 
 

মার্কসীয় চেতনা ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের আলোকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস বিশ্লেষণ ‘‘দিবারাত্রির কাব্য’’

প্রীতম প্রামানিক

প্রাক্তন ছাত্র,উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
 
 
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (মে ১৯, ১৯০৮ - ডিসেম্বর ৩, ১৯৫৬) এক জন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েক জন লেখকের হাতে বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা মানিক গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে তিনি রচনা করেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোট গল্প। তাঁর রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসী মামি, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্প সংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। বাংলা ছাড়াও তাঁর রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।
পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের ছাত্র জীবন অতিবাহিত হয় বাংলা-বিহার-ওড়িশার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদি নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথায়। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের কারণে ওই সকল মানুষের জীবনচিত্র সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল মানিকের। তাই ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে তাঁর সাহিত্যে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেনপদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার পটভূমিতে রচনা করেন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি।
জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া মার্কসবাদও তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম গল্পগুচ্ছ অতসী মামি ও অন্যান্য সংকলনে সব কয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। এ ছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবনচিত্রও তাঁর বেশ কিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তাঁর সাহিত্যের মুল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙাগড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমারতটি দাঁড়িয়ে কঠিন কঠোর বাস্তবতা ও বাস্তববোধের উপর। শোষণ ও বৈষম্য পীড়িত একটি সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা যে কেবল মাত্র মার্কসবাদ প্রদর্শিত পথেই হতে পারে তাই নির্দ্বিধায় তিনি মার্কসবাদ কে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে সাহিত্যে আনলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের এই বাস্তববাদ কে সোশ্যালিস্টিক রিয়ালিজম বা সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ বলা যেতে পারে।তাঁর যে সব রচনায় ফ্রয়েডীয় চিন্তাধারার প্রকাশ লক্ষিত হয়,তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মানদীর মাঝিমনোবিকলন ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বে ভরপুর তাঁর এই রচনাগুলো। মার্কসীয় ধারনায় যে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা এবং চরিত্রকে প্রভাবান্বিত করে সেখানে মানিক তাদের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চরিত্রচিত্রণে এবং রুপায়নে হেরিডিতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, এটায় তাঁর রচনায় ফ্রয়েডিও আলোকপাত।

দিবারাত্রির কাব্য" বই আকারে প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩৫এর ২২ শে জুলাই কলকাতার ডিএম লাইব্রেরী থেকে      তবে বঙ্গশ্রী পত্রিকায় আরো আগেই ভিন্ননামে ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়"দিবারাত্রির কাব্য" মানিকবাবুর একটি
ভিন্নধর্মী উপন্যাস। মানিকবাবু নিজেই এটির ব্যাপারে বলেছেন-"এটিগল্পও নয়, উপন্যাসও নয়, এটি রুপকের আরেকরুপউপন্যাসটি যেমন নানাবিধ জটিল ঘটনাপ্রবাহ এবংততোধিক জটিল বিশ্লেষণধর্মী তাত্ত্বিকআলোচনায় পূর্ণ, তেমনি উপন্যাসের ব্যাপারেমানিকের করা এই মন্তব্যটিও বেশ ধাঁধাঁয় মোড়ানোরুপকের আরেক রুপ? সেটা কী? রুপক বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন?হয়ত বলতে চেয়েছেন, এটি গতানুগতিক উপন্যাসের অবকাঠামো থেকে ভিন্ন একটি রুপকাশ্রয়ী লেখা,যাতে জীবনের স্থূলবাস্তবতা ছাপিয়ে উঠে এসেছে মানবমনের সূক্ষ্ম জীবনবোধ, তা রুপকের আশ্রয়ে

দিবারাত্রির কাব্যউপন্যাসটিতে তিনি প্রেমের কাব্যময়তার কোনো কারন খুঁজে পাননিপ্রেম শুধুই জৈবিক প্রবৃত্তির কালাজ্বর- একটা দেহবিলাস মাত্রএই উপন্যাসের সবচেয়ে জটিল চরিত্র হেরম্বদেহ-কামনায় উত্তপ্ত বিকৃত মানসিকতার প্রতিনিধি।মানিক খুব সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেনদিবারাত্রির কাব্য’(১৯৩৫) উপন্যাসটিতে।
উপন্যাসটি যখন ১৯৩৫-র ডিসেম্বরে ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়,তখন গ্রন্থের নামপত্রে দিবারাত্রির কাব্যশিরোনামের সঙ্গে একটি বস্তু সংকেতের কল্পনা মূলক রূপক কাহিনি বলে একটি উপনাম সংযোজিত ছিল,যা পরবর্তী সংস্করণগুলিতে বর্জিত হয়েছিল।উপন্যাসটির শুরুতে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছোট ভূমিকাটি আছে সেখানে তিনি লিখেছেন –“দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনও মনে হয় বইখানা খাপছাড়া,অস্বাভাবিক,-তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাস ও নয় রূপক কাহিনি ।রুপকের এ একটা নতুন রূপ।একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে,বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভুতি যা দাঁড়ায় ,সেই গুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হএছে।চরিত্র গুলো কেউ মানুষ নয়,মানুষের projection-মানুষের এক টুকরো মানসিক অংশ।’’
 
উপন্যাস সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি উপন্যাসটি ভাগে বিভক্ত- )দিনের কাব্য ২)রাতের কাব্য ) দিবারাত্রির
কাব্যপ্রতিটি পর্বের শুরুতে চার স্তবকের একটি কবিতা দেয়া হয়েছে, মূলত যা পর্বে বর্ণিত কাহিনীসারের সংক্ষিপ্ত অভ্যন্তরীণ মর্মের কাব্যরুপউপন্যাসটি পাঠের পর মনে হয় প্রধান তিন চরিত্র আসলে মানুষের মনোজগতের ভিন্ন ভিন্ন স্তরের পরিচায়ক ।আমরা উপন্যাসটির  মুখ্য চরিত্র হেরম্বের মধ্যে মানিক বন্দো পাধ্যায় ফ্রয়েড কথিত মানুষের মনের চেতন অংশ বা super ego কেই যেন ফুটিয়ে তূলতে চেয়েছেন। উপন্যাসটিতে হেরম্ব চরিত্রের এক ধরণের বিকাশ আছে।
 
প্রথম ভাগে আমরা দেখি, গল্পের নায়ক ত্রিশোর্ধ্ব কলেজ প্রফেসর এবং কবি হেরম্ব তার শৈশবের গ্রামের খেলার সাথী সুপ্রিয়ার স্বামী ইন্সপেক্টর শংকরের রুপাইকুড়ার বাড়িতে হাজির হয় সুপ্রিয়া কৈশোরে হেরম্বকে ভালোবাসতো, হেরম্বও হয়ত বাসতো হয়ত একারণে বলছি যে,সুপ্রিয়ার ব্যাপারে হেরম্বের মনোভাব একটা ধোঁয়াশার মত উহ্য রাখাহয়েছে সুপ্রিয়াকে জোর করে সেই বন্ধু শংকরের সাথে বিয়ে দেয়বিয়ের পাঁচবছর পরেও সুপ্রিয়া তাকে ভুলতে পারেনি একবিন্দু বরং পাঁচবছর পর তাকে দেখে আত্মনিবেদনে আকুল হয় বিভিন্নভাবে সে হেরম্বের মনোভাব বোঝার চেষ্টাকরে কিন্তু রহস্যে ঢাকা হেরম্ব তা বুঝতে দেয় না হেরম্বের স্ত্রী উমার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যাকে সুপ্রিয়া জানতো যে তাকে হেরম্ব ভালোবাসতো বলেই উমা আত্মহত্যা করেছেকিন্তু হেরম্ব জানায় সে উমাকে তার কথা বলেইনি
এই উপন্যাসটির প্রথম অংশ অর্থাৎ দিনের কবিতায়আমরা যে হেরম্বকে পাই,সে কোনোভাবেই নিজের idকে প্রশ্রয় দেয় না।সামাজিক নীতিবোধের জায়গা থেকেই সে সুপ্রিয়াকে  অশোকের সাথে উৎসাহিত করেছিল।উপন্যাসে এক জায়গায় সুপ্রিয়া তাকে বলে,“ আমাকে ভজিয়ে ভজিয়ে রাজি করিয়েছিল কে?কার মুখের বড় বড় ভবিষ্যৎ বানী শুনে আমি ভেসে গিয়েছিলাম? কী সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কথা!কত কথার মানে বুঝিনি।তবু শুনে গা শিউড়ে উঠেছিল। আচ্ছা সেসব কথা অভিধানে আছে?”
যদিও হেরম্ব জানত সুপ্রিয়া তাকে ভালোবাসে কিন্তু Super Ego তো Id এর কোনো অসামাজিক ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয় নাহ।ফলে অভিধানসম্মত জ্ঞ্যানের সাহায্যেই Id অবদমিত হয় ।আর সামাজিকতার নীতিবোধ-বিরোধী ইচ্ছাকে যারা চরিতার্থ করতে চায় ,চরিতার্থ করে। ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনে তো তারায় মানসিক ভাবে অসুস্থ পাগল ।সে কারনেই সুপ্রিয়ার  সেই সময়ের কার্যকলাপ হেরম্বের কাছে পাগলামি বলেই মনে হয়, ‘‘তখন তুই পাগলিই ছিলি সুপ্রিয়া’’
হেরম্বতো মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের ফ্রয়েড পাঠের ফল।হেরম্ব একই সাথে therapist ও সে-কারনেই তাঁর কাছে মেয়েদের মনোজগত খুব স্পষ্ট ।একেধার থেকে রান্না করে যাওয়ার পাগলামি মেয়েদের কেন আসে হেরম্বের তা অজানা নয়।
 
এই উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ রাতের কবিতাতে আমরা দেখি আনন্দর সঙ্গে হেরম্বের সাক্ষাৎ এবং সম্পর্ক স্থাপন।উপন্যাসের এই দ্বিতীয় অংশে এসে কিন্তু ঔপন্যাসিক মানিক হেরম্ব চরিত্রের অবস্থানকে নানা ভাবে সমস্যায়িত করেছেন,যে‘‘হেরম্বের ধারনা ছিল কাব্যকে,বিশেষ করে চাঁদের আলোকে সে বহুকাল পূর্বেই কাটিয়ে উঠেছে’’৪ সেই চেতন রুপী হেরম্বকে তিনি সিনিক আখ্যা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়,হেরম্ব চরিত্রের স্থৈয ও সঠিকতা বোধের মধ্যে ফাটল ধরিয়েছেন ঔপন্যাসিক।
 
 এই উপন্যাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া চরিত্র পাঠেও আমরা পুরোপুরি ফ্রয়েডীও ভাবনার প্রতিফলন দেখি।সুপ্রিয়া যেন হেরম্বের উলটোমুখী চরিত্র রুপে উপন্যাসে রয়েছে।হেরম্ব যদি মনের চেতন স্তর রুপে দ্বারা পরিচালিত হয়,তবে সুপ্রিয়া যেন হেরম্বের মানব মনের অবচেতন/চেতন স্তরের মূর্ত রূপক।সে চালিত হয় Id -এর কামনা বাসনার দ্বারা ও যৌন ইচ্ছের দ্বারা।উপন্যাসে দেখি তাঁর ফিটএবং রোগ আছে বছরে সে দুই তিন বার ফিট হয়’’৫এখানে তথ্য হিসেবে জানানো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে,ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী লিঙ্গহীনতা জনিত হীনমন্যতাবোধ নারীর মনে যে প্রতিরোধ পদ্ধতি বা Defence Mechanism-এর জন্ম দেই,তার একটি অন্যতম উপাদান হল মাঝে মাঝে অচেতন হয়ে যাওয়া।
 
সুপ্রিয়ার জীবনের মুল চালিকা শক্তি তার লিবিডো ।সুপ্রিয়া চরিত্র পাঠে আমাদের লেখকের অন্যতম উপন্যাস পুতল নাচের ইতিকথার কুসুম এর পূর্বসূরি বলেই যেন মনে হয়।কুসুম যেমন তার যৌন প্রবৃত্তির টানে পরানকে ছেড়ে শশী ডাক্তারের কাছে চলে যেতে পারে,তেমনই সুপ্রিয়া হেরম্বকে বলে –“আপনি আমাকে ডাকলেই পারেন।আপনি বললেই বিছানায় উঠে বসতে পারি”.
অশোকের সঙ্গে  সুপ্রিয়ার বিবাহ হলেও সে এই বিয়েতে সুখী নয় ।তার মন ছুটে চলে কামনার হেরম্বের প্রতি।সামাজিক রীতিনীতিবোধ কে অস্বীকার করে সে প্রাণপুরুষ হেরম্বকেই কাছে পেতে চাইআর যখন তাঁর সৎ কিন্তু অসামাজিক ইচ্ছে,মনের স্তর রুপী হেরম্ব চরিতার্থ করতে দেয় না,তখন বলে ওঠে ‘‘….আপনি মেয়ে মানুষের সর্বনাশ করেন আর তাদের ভার নেওয়ার বেলায় এড়িয়ে যান’’
তবুও কি অবচেতন,অচেতন চূড়ান্ত ভাবে অবদমিত হয়?ফ্রয়েড তো বলেন না ।অচেতন তাঁর উপস্থিতি জানান দেয় ,টুকরো আশা তৈরি করে আর কেবলি দৃ্শ্যের জন্ম হয়
যে শরীর শুধু চোখে দেখার সান্নিধ্যে খুশি হয় না,কাউকে খুশি করতে হলে সে-শরীরের লজ্জাএকটু কমাতে হয়। শরীর সুখের জন্য অবদমিত যে অবসাদ(Depression),ফ্রয়েডীও মতে তাঁর ফলে সুপ্রিয়ার কিছু ভালো লাগে না।কিন্তু সুপ্রিয়া তো জেনে গেছে ও আর চাই না সুপ্রিয়ার দেহ,না চাই তার মন’’
এই সত্য জানবার পরও কি সুপ্রিয়া নিজের বাস্তবকে অস্বীকার করতে চায়?বদলে ফেলতে চাই নিজেকে উপন্যাস তো নেতিবাচক উত্তর দেয়।সে আবার তাই হেরম্বের জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করবে ,আবার স্বপ্ন দেখবে ,আরো আরো নতুন ভাবনার আগমন হবে।সে কারনেই এই উপন্যাসের প্রথম অংশ অর্থাৎ দিনের কবিতার বাক্যটি এইরকম-‘‘আজ রাতে যদি বৃষ্টি হয় কাল তাহলে মাঠের বিবর্ণ বিশীর্ণ তৃণ প্রানবন্ত হয়ে উঠবে।’’
মনোবিকোলন নিয়ে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল উপমা বা প্রতীকের জগৎ।ফ্রয়েডের মতে আমরা যা দেখি,তা আসলে আমাদের নানা অবদমিত ইচ্ছার প্রতীকের সমাহার।এই উপন্যাসে বিভিন্ন প্রতীকের ব্যাবহার দেখা যায় সুপ্রিয়া সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য করা হয়েছে,‘‘ইঁদারার জলের ঠাণ্ডা মেয়েটা হটাৎ বরফ হয়ে গেছে১০হেরম্ব সুপ্রিয়ার নিয়ে এইরুপ অনেকগুলো প্রতীকের ব্যবহার আমরা উপন্যাসে লক্ষ্য করি।-“গরমে আগুনের তাঁতে যখন সুপ্রিয়া ঘেমে ওঠে তখন হেরম্ব স্নিগ্ধ ছায়ায় শোবার ঘরের বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে আর দুজনের মাঝে উঠানের ব্যবধান ভরে ঝাঁঝালো করা রোদটা সুপ্রিয়ার কাছে রুপকের মত ঠেকল’’ ১১
অথবা হেরম্ব যখন রুপাইকুড়ায়  তাদের বাড়িতে আসে তখন সুপ্রিয়ার মনে হয় ‘‘তাঁর কল্পনা ও স্বপ্ন অবশিষ্টটুকু মুছে নেওয়ার উদ্দেশেই হেরম্ব তাদের বাড়িতে পদার্পণ করেছে।তাকেও শাসন করবে সংকীর্ণ সংক্ষিপ্ত  একটি বাগানে মুল বিস্তার করবে বলে তার সব বাহুল্য ডালপালা ছেঁটে ফেলবে। এমন একটি শাখা রাখবে না যাতে অনাবস্যক ফুল ফুটতে পারে১২
মোদ্দাকথা, সুপ্রিয়া হেরম্বকে পাগলের মত ভালোবাসলেও বিশ্লেষণপ্রিয় হেরম্ব তার ও সুপ্রিয়ার সম্পর্কটিকে অহেতুক বিশ্লেষণে জটিল করে ফেলেছিল তার চিন্তায় ছিল, সুপ্রিয়া হয়ত তার কৈশোরিক উত্তেজনার বশে তাকে কামনাকরেছিল, ওটা মোহ কিন্তু পাঁচবছরেও প্রেম ওমনি থাকায় হেরম্বের ভাবান্তর ঘটেতাই রাতেসুপ্রিয়া তারসাথে পালিয়ে যাবার কথা বললে হেরম্ব ভাবে-"সুপ্রিয়াকে জীবনের সাথে গেঁথে ফেললে হয়ত চিরদিনের জন্য জীবন এত অপূর্ণ থাকবে যে পরে আফসোস করতে হবে, তারএই আশঙ্কা কমে আসে তার মনেহয় সুপ্রিয়া আজ একদিনে ক্ষণে ক্ষণে নিজের যে নব নব 
পরিচয় দিয়েছে তা হয়ত বহু সংযম সাবধানতা কার্পণ্যের বাধা ঠেলেই বাইরে এসেছে"
সুপ্রিয়ার জীবনের মুল চালিকা শক্তি  লিবিডো- সারা দুপুর সুপ্রিয়া এই কথা ভেবেছেভেবেছে আমার এই শরীরটা এত সুন্দর নয় যে শুধু চোখে দেখার সান্নিধ্যে কেউ খুশি হয়।আর মনের বাজে খেয়ালটা নষ্ট করে দিতে হলে আমাকে একটু লজ্জা কমাতে হবে। ওর কী কাল চলে গেলে মস্ত একটা ত্যাগ করার গৌরব নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। সর্বনাশ আমার। কাব্য নিয়ে থাকলে চলবে কেন?আমি যে একটি দিনের জন্য সুখ পেলাম না,সারাদিন আমার যে কিছু ভালো লাগে না।কিছুই ভালো লাগে না-’’১৩।তবু হেরম্ব সাহস পায়না,তাই ছয়মাসের সময় চেয়ে সে চলে আসেদ্বিতীয় ভাগে দেখা যায়, হেরম্বের তার শৈশবের বড়আপা স্থানীয় ভালোবাসার মানুশ মালতীর স্বামীর সাথে দেখাহয় মালতীকে হেরম্ব পছন্দ করত 
কিন্তু মালতী তার দাদার মাস্টার অনাথের সাথে পালিয়ে এসে পুরীর এক জঙ্গলে বৈষ্ণবী হয়ে মন্দিরের সেবাদাসীর ব্রত নেয়
অনাথের সংসার ধর্মে মন উঠে গিয়ে বৈরাগ্য চলে আসে, আর সেই বিরহের আগুনে পুড়ে পুড়ে মালতীর ভেতরে আসে অস্বাভাবিক সব স্বভাবসে মদ খায়, উন্মাদের মত থাকে তার মেয়েআনন্দকে দেখে চিরকাল বিশ্লেষণপ্রিয় হেরম্বের ভেতরে বিশ্লেষণের অতীত যে শাশ্বত প্রেম, তাই আবির্ভাব হল আনন্দকে দেখে হেরম্বের আত্মোপলব্ধি হয়, এতকাল সে মনের ভেতর নিজের অজান্তেই দুটি সত্যকে পুষেছেহেরম্ব এতদিন ভাবত সে তার বিশ্লেষণধর্মী যুক্তির অনুকূলে, মানবমনের যে আরো অদ্ভুত যৌক্তিক অংশটি হল মন, আবেগ এবং অযুক্তি-হেরম্ব ভাবত একথা সে মানেনা কিন্তু আনন্দকে দেখে হেরম্বের ভেতরে সঞ্চারিত অদ্ভুত পুলকে তার এই ধারনা ব্যর্থহয়! যে চাঁদের আলোকে সে স্রেফ " আলোতে চোখ জ্বলেনা তাই এটা ভালো" বলে ভাবত আজ আনন্দের মুখে সে আলোকে তার অপার্থিব লাগে

মানিক তার অবস্থাটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-"কাব্যকে অসুস্থ নার্ভের টঙ্কার বলে জেনেও আজ পর্যন্ত তার কাব্যপিপাসা রয়ে গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কল্পনার যোগসূত্রটি আজো ছিঁড়ে যায়নি রোমান্সে আজো তার অন্ধবিশ্বাস, আকুল উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগ আজো তার কাছে হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ পরিচয়...... হৃদয়ের অন্ধসত্য এতকাল তার মস্তিষ্কের নিশ্চিত সত্যের সাথে লড়াই করেছে তার ফলে জীবনের কোনদিকে তার সমতা থাকেনি দুটি বিরুদ্ধ সত্যের একটিকে সজ্ঞানে আরেকটিকে অজ্ঞাতসারেসে মর্যাদা দিয়ে এসে জীবনটা তার ভরে উঠেছে মিথ্যাতে" হেরম্বের এই বিপরীতধর্মী দুই অন্তকরণের কারণেই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বিশ্লেষণধর্মী হেরম্ব সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করলেও দুর্বল আবেগী ওযুক্তির চেয়ে বড় বাস্তব হৃদ্যিক হেরম্ব গোপনেই তাকে ভালোবেসে গেছেআর আজ আনন্দকে দেখে সেই আবেগী হেরম্বই জয়ী হল, হেরম্ব আনন্দের প্রেমে পড়ল তৃতীয় ভাগটি সবচেয়ে জটিল হেরম্বকে খুঁজতে সুপ্রিয়া পুরীতে আসে আনন্দকে হেরম্ববলেছিল প্রেম খুব অল্পসময় বাঁচে তারপর যা থাকে তা হলো অভ্যেস এইসত্য নিজের পিতামাতার ভেতরে দেখেছিল আনন্দ কিন্তু ত্রিশোর্ধ্ব হেরম্ব যা বোঝে তা সদ্যযৌবনা প্রেমে উন্মাদআনন্দ বোঝেনা অথচ সে প্রেমের এইবাস্তবতার প্রত্যক্ষদর্শী ফলে আনন্দেরকিশোরী মন শুরু হতে না হতেই প্রেমের এই দার্শনিক সত্যে বিচলিত বিমর্ষ হয়ে পড়ে হেরম্বের পক্ষেও আর প্রথম যৌবনের অগ্নিউত্তাপ নিয়ে তাকে ভালোবাসা সম্ভব হয়নাফলে তাদের প্রেম একটি অকালে জন্ম নেয়াশিশুর মত বাঁচার ইচ্ছায় ভরপুর অথচ বিকলাঙ্গ হয়ে থাকে এর মধ্যে সুপ্রিয়ার সাথে হেরম্বের দেখা হয় অসুস্থ অশোককে রেখে সুপ্রিয়া পালিয়ে যেতে চায় তারসাথেঅথচ মালতীকে হেরম্ব আনন্দকে বিয়ে করার কথা দিয়েছে সে ছুঁতো দিয়ে চলে আসে মালতীকে ছেড়ে অনাথ চলে যাওয়ায় মালতী ঘরছেড়ে চলে যায়!আনন্দ ভুল প্রেমে আগেই নিঃশেষিত ছিল,সুপ্রিয়াকে দেখে তার মন হিংসায় ভরে যায়হেরম্ব নতুন করে তাকে নিয়ে বাঁচতে চায়কিন্তু আগুন জ্বালিয়ে নাচতে গিয়ে আনন্দ তাতে পড়ে মারা যায় "আনন্দ অনেক আগেই মরেছে কেবল চিতায় উঠবার শক্তিটুক বাকী ছিল"১৪

উপন্যাস সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দেখা যায় যে উপন্যাসটির চরিত্র গুলি ফ্রয়েডী চেতনায় আচ্ছাদিত যা মনের চেতনস্তর রুপী হেরম্বের অবচেতন মন,সুপ্রিয়ার অচেতন স্তরের মনোভাব,মালতী আনন্দর কামনা প্রকাশ করছে ফ্রয়েডের যে নারী সম্পর্কিত মনোভাবকে নারীবাদীরা নারীবিরোধী বলে বর্ণনা করেছেন হেরম্বের মতে মেয়েদের-‘‘মনের শৈশব কোনোদিনই ঘুচতে চাই নাঘুন যদি ধরে তো একেবারে কাঁচা মনেই ধরে,নইলে ওরা আজন্ম শিশু১৫

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্য ভাবনার এক অন্যতম প্রেরনা ছিল বিজ্ঞানবোধ যা আমরা তাঁর অধিকাংশ লেখাতে লক্ষ্য করেছিধরে নেওয়া যেতে পারে বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ থেকেই তাঁর ফ্রয়েডের তত্ত্বের প্রতি এতো আকর্ষণসেই সুত্রেই তাঁর উপন্যাসে ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের প্রভাব    

   ❖    উল্লেখপঞ্জিঃ

    .মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘‘দিবারাত্রির কাব্য’’চিরায়ত প্রকাশন কলকাতা .১৯৯৯ সংস্করণ

    . পৃষ্ঠা

    . পৃষ্ঠা

    . পৃষ্ঠা ৬২

    . পৃষ্ঠা

    . পৃষ্ঠা ১৭

    পৃষ্ঠা ২২

    . পৃষ্ঠা ২৩

    . পৃষ্ঠা ৩২

    ১০. পৃষ্ঠা ১০

    ১১. পৃষ্ঠা

    ১২. পৃষ্ঠা

    ১৩. পৃষ্ঠা ১২

    ১৪. পৃষ্ঠা ৭৯

    ১৫. পৃষ্ঠা

    ১৬. দুই  বিশ্বযুদ্ধের  মধ্যকালীন কথা সাহিত্য-গোপীকানাথ রায় চৌধুরী, দে পাবলিশিং, কলকাতা ৭৩( সেপ্টেম্বর ১৯৮৬)

    ১৭. বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা- শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,মডার্ন বুক এজেন্সী ,কলকাতা-৭৩( অষ্টম সংস্করণ ১৯৮৮)

 


No comments:

Post a Comment

হৃদয়ের অন্বেষণে

হৃদয়ের অন্বেষণে হৃদয়ের অন্বেষণে ক্রমাগত চলছে মানব সভ্যতা যুগ যুগ ধরে চলছেই সভ্যতার দমন পীড়ন মনোভাব । তাতে কার কি আসে যায়...